সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫ - ২১:৫২
জান্নাত কি গোয়ালঘর?

আবু সুফিয়ান, মুয়াবিয়া, ইয়াজিদ—জান্নাতি? আর আহলে বাইতের প্রেমিকরা জাহান্নামী? এক চরম বিতর্কের বিশ্লেষণ

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, আবু সুফিয়ান, মুয়াবিয়া, ইয়াজিদ—জান্নাতি? আর আহলে বাইতের প্রেমিকরা জাহান্নামী? এক চরম বিতর্কের বিশ্লেষণ

ভূমিকা

ইসলামের ইতিহাস এবং ধর্মতত্ত্ব চিরকালই বিভিন্ন মতপার্থক্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। কিন্তু কিছু প্রশ্ন এমন রয়েছে যা একে শুধুমাত্র মতভেদ নয়, ন্যায়ের মাপকাঠিতেও চরম বিতর্কিত করে তোলে। যেমন—ইসলামপূর্ব ও ইসলামবিরোধী ভূমিকার জন্য সুপরিচিত ব্যক্তিরা, কেবলমাত্র “নবীজির সাহাবি” ছিলেন বলে কি জান্নাতি হতে পারেন? অথবা, যারা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আহলে বাইতের (আ.) জন্য প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে, তাদের 'ফাসেক' ও 'জাহান্নামী' বলা কি ইসলামের ন্যায়বিচারপূর্ণ মানদণ্ডে টেকে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের দরকার ইতিহাস, হাদিস, যুক্তি ও নৈতিকতাভিত্তিক মূল্যায়ন।

সাহাবিদের মর্যাদা: সীমাহীন নাকি শর্তসাপেক্ষ?

আহলে সুন্নাতের অনেক দল বিশ্বাস করে—“সাহাবা সকলেই ন্যায়পরায়ণ”। অথচ কুরআন এমন বিচার-বিবেচনাহীন সার্বিক মন্তব্য দেয় না। বরং আল্লাহ বলেন:

“আর তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও আছে যারা পিছিয়ে পড়ে, আর কেউ কেউ সামনের সারিতে থাকে।”
(সূরা আত-তাওবা 9:100)

এছাড়াও, সুরা মুুনাফিকূনে এক শ্রেণীর মানুষকে বর্ণনা করা হয়েছে যারা মুখে ঈমান আনে, কিন্তু অন্তরে কুফরি বহন করে। এদের অনেকেই ছিল নবীর সাহচর্যে।

আবু সুফিয়ান (لعنة الله علیه):

ইসলাম গ্রহণ করেন মক্কা বিজয়ের সময়, বাধ্য হয়ে।

তাঁর পরিবার ইসলামবিরোধী যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়—উহুদ, বদর ইত্যাদি।

ইসলামের প্রচারে তার বিরোধিতা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ।

নবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁকে রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দেখা যায়।

মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান:

হযরত আলী (আ.)-র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন (যেমন সিফফিন)।

খলীফাতুল রসুল বলে দাবিদার হলেও ইসলামী ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হন।

ইসলামের প্রথম মনার্কি/বংশানুক্রমিক রাজত্ব তার হাত ধরেই শুরু হয়।

হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করে ইয়াজিদকে মনোনয়ন দেন।

ইয়াজিদ:

কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ.)-কে নির্মমভাবে হত্যা করে।

মদ্যপান, নাচ-গান, ব্যভিচার ও ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল।

তার শাসনামলে মদিনায় 'হাররার যুদ্ধ'-এ হাজার হাজার সাহাবি নারী ধর্ষিতায় লিপ্ত হয়।

সে নিজেই বলেছিল: “বনু হাশিম খেলায় মেতে উঠে খেলাফতের নামে, অথচ ওহি বলে কিছুই নাজিল হয়নি!” (তাবারী, তারীখ)

এমন ব্যক্তিদের জান্নাতি বলা কি ইসলামের বিচারবোধে টেকে?

আহলে বাইতের অনুসারীরা কি 'ফাসেক'?

আজ বহু জায়গায় শোনা যায়—"যারা মাতম করে, মজলিস করে, আহলে বাইতের (আ.) জন্য কান্নাকাটি করে, তারা 'বিদআতি', 'গোমরাহ', এমনকি 'জাহান্নামী'।"

তবে হাদিসে কি বলা হয়েছে?

রাসূল (সা.) বলেন: "হুসাইন আমার থেকে, আমি হুসাইন থেকে।" (তিরমিযী, সহীহ হাদীস)

"হাসান ও হুসাইন জান্নাতি যুবকদের নেতা।" (তিরমিযী, মুসলিম)

"যে আমার আহলে বাইতকে ভালোবাসে, সে আমার সঙ্গী হবে; যে ঘৃণা করে, সে জাহান্নামী।"

জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন: “আমি নবীজিকে কাঁদতে দেখেছি, যখন তিনি হুসাইনের শাহাদাতের ভবিষ্যদ্বাণী করলেন।” (মুসনাদে আহমাদ)

তাহলে যারা আহলে বাইতের জন্য কাঁদে, তারা ‘ফাসেক’ কীভাবে হয়?

মজলিস, মাতম ও শোক: কুরআন ও হাদিসে দৃষ্টিভঙ্গি

কুরআনে শোক প্রকাশকে কখনও নিষিদ্ধ করা হয়নি। বরং হযরত ইয়াকুব (আ.) তার পুত্র ইউসুফ (আ.)-এর বিচ্ছেদে চোখ হারিয়ে ফেলেন কান্না করতে করতে।

"তবে সে এত কাঁদল ইউসুফের জন্য, যে তার চোখ অন্ধ হয়ে গেল।" (সূরা ইউসুফ)

তাহলে ৭২ জন শহীদ ও রাসূলের প্রাণপ্রিয় নাতি ইমাম হুসাইনের জন্য কাঁদলে, তা 'হারাম' বা 'বিদআত' হয় কীভাবে?

বিচার কি চোখে দেখা অনুযায়ী?

"ফলানা ব্যক্তি নবীকে দেখেছে, তাই সে জান্নাতি"—এমন যুক্তি কুরআনের শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ—

আবু লাহাবও নবীকে দেখেছে, তার চাচা ছিল। কিন্তু কুরআনে তাকে জাহান্নামী ঘোষণা করা হয়েছে:

“তাব্বত ইয়াদা আবি লাহাবিন...”

দেখা নয়, কর্মই শেষ বিচার। যারা নবীকে দেখেছে কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে (যেমন আবু সুফিয়ান, মুয়াবিয়া, ইয়াজিদ), তারা চোখের সওয়াব না, অপরাধের শাস্তি পাবে।

উপসংহার: জান্নাত কি গোয়ালঘর?

না, জান্নাত কখনোই গোয়ালঘর নয় যে, সেখানে শুধু পরিচিতি বা দেখার সুবাদে কেউ ঢুকে পড়বে। ইসলাম বিচার করে আকিদা, আচরণ এবং আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি আনুগত্য অনুযায়ী।

যারা আহলে বাইতের জন্য কাঁদে, তাদের ভালোবাসে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তোলে—তারা ফাসেক নয়, বরং তারা সেই সত্যের ধারক যাদের জন্য ইসলাম আজও বেঁচে আছে।

শেষ কথা:

জান্নাত-জাহান্নামের মালিক আল্লাহ। তবে তাঁর দেওয়া ন্যায়ের মানদণ্ড স্পষ্ট:
"যে বেশি তাকওয়া অবলম্বন করে, সে-ই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন" (সূরা হুজুরাত)

আহলে বাইতের প্রেমিকদের ‘বিদআতি’ ও ‘ফাসেক’ বলে দাগিয়ে দিয়ে, আর ক্ষমতালোভী, মদ্যপ শাসকদের ‘জান্নাতি সাহাবি’ বানিয়ে দিলে শুধু ইতিহাস বিকৃত হয় না, ন্যায়বিচারক আল্লাহর প্রতি অবিচার করা হয়।

রিপোর্ট: হাসান রেজা 

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha